হাতিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে কোটি কোটি টাকা ঘুষ বানিজ্য, ৫০% শেয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর

📄🖋: মামুন রাফী, স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ মাস আগে
হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী, আব্দুল জব্বার, নাজিম উদ্দীন

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার পিটিআই (ডিপিএড/সিইনএড) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের নিম্নধাপ থেকে উচ্চধাপে বেতন নির্ধারণ সহ বকেয়া বিল প্রদানের ক্ষেত্রে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আ. জব্বার, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা এ.বি.এম নুরেজ্জমান ও উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।

সরকারের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সারাদেশের মতো হাতিয়া উপজেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চধাপে বেতন পাওয়ার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উচ্চমান সহকারী কাম হিসাব রক্ষকের সাথে যোগাযোগ করে থাকে। শিক্ষকরা তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা শিক্ষা অফিসের দীর্ঘদিনের অবৈধ অর্থ আদায়ের কাজে নিয়োজিত এজেন্ট দক্ষিণ চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এনায়েতে রাব্বীর সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষা অফিসের নির্দেশে শিক্ষকরা এনায়েতে রাব্বীর সাথে দেখা করলে তিনি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক নাজিম উদ্দিনের পক্ষ হয়ে শিক্ষকদের একজন করে আলাদাভাবে ডেকে এনে প্রতি শিক্ষকের অনলাইন বেতন নির্ধারণের জন্য ও চাকরির খতিয়ান বহি হালফিল করা বাবদ ৮ হাজার টাকা আর বকেয়া বিল বাবদ ১২ হাজার টাকা করে-প্রতি শিক্ষক হতে মোট ২০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে।

শিক্ষা অফিসের নিয়োজিত এজেন্ট এনায়েতে রাব্বীর দাবি অনুযায়ী তাকে যে সকল শিক্ষক ২০ হাজার টাকা করে দেয় তখন তাদের স্বল্প সময়ে বেতন নির্ধারণ সহ বকেয়া বিল পরিশোধ করে দেয়। গোপনীয়তা রক্ষা করে ১ জন করে ডেকে এনে ঘুষের টাকা আদায় করার মূল রহস্য হল এ অবৈধ অর্থ আদায়কে কেন্দ্র করে যেন শিক্ষকদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ না হয় এবং গণমাধ্যমগুলো যেন আঁচ করতে না পারে।

শিক্ষা অফিসের প্রত্যাশানুযায়ী ঘুষ প্রাপ্তির পরবর্তী উক্ত শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের তারিখ অনুযায়ী পেছনের তারিখ ও বিল নং দিয়ে তাদের বকেয়া বিল পরিশোধ করে দেয়। যার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিল পাসের তারিখের সাথে এসব শিক্ষকের ব্যাংক বিবরণীর মাসেরও মিল থাকেনা। এভাবে নগদ টাকা আদায়ের মাধ্যমে সেপ্টেম্বর ২০২৩ খৃঃ থেকে ১০-২০জন করে ধাপে ধাপে বেতন নির্ধারণ করে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে শতাধিক শিক্ষকের ও বর্তমান ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে দুই শতাধিক শিক্ষকের এ সংক্রান্ত কাজ সম্পাদন করে থাকে উপজেলা শিক্ষা অফিস।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষকের দাবি অনুযায়ী ঘুষ না দেওয়ায় এক বছরেও অর্ধেক শিক্ষকের বেতন নির্ধারণ এবং বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়নি। যার কারণে অনেক শিক্ষকের নিয়োগ ও পিটিআই, প্রশিক্ষণ পাসের তারিখের সময়কাল আগে হলেও বেতন পেয়ে থাকে জুনিয়রদের থেকে অনেক কম। হাতিয়া উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য ও অফিসিয়াল ডকুমেন্টস থেকে বেরিয়ে আসে উচ্চমান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক নাজিম উদ্দিনের যোগসাজসে প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের নানা অনিয়মের পাহাড়সম এসব তথ্য।

উপজেলার ২২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদ রয়েছে ১হাজার ৪শত ৪৪টি। এ পদগুলোর মধ্যে কেবল ২০০৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ২০২০ সালে শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেড পাওয়ার আগ পর্যন্ত পিটিআই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় ৬০০ জন শিক্ষক দীর্ঘদিন নিম্নধাপে বেতন ভাতাদি ভোগ করে আসছেন। শিক্ষা অফিস এসকল শিক্ষক থেকে ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ আদায় করলে শুধু এ কাজে আদায় হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।

ঘুষ ছাড়া হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে কোনো কাজই হয়না। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আ: জব্বারের নির্দেশে দীর্ঘদিন থেকে এ ঘুষের টাকা আদায় করে আসছেন শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক নাজিম উদ্দিন ও দক্ষিণ চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এনায়েতে রাব্বী। শ্রেণী কার্যক্রম চলাকালীন সময়েও তিনি অফিসে আনাগোনা করে থাকে। শিক্ষকদের চাকরি বহিগুলো নিজের হাতে ও নির্দিষ্ট কয়েকজন শিক্ষক দিয়ে হালফিল করে থাকে। শিক্ষকদের পেনশন বিল, বিভিন্ন বকেয়া বিলসহ চাকুরির খতিয়ান বহি গুলো উচ্চমান সহকারী নাজিম উদ্দিন কর্তৃক হালফিল করার কথা থাকলেও তিনি নিজের হাতে লেখেন না। এই ক্ষেত্রে নাজিম উদ্দিন শুধু শিক্ষক এনায়েতে রাব্বি সহ নির্ধারিত শিক্ষকদের থেকে ঘুষের টাকা সংগ্রহ করে নিজের অংশ রেখে বাকি অংশ প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, শিক্ষক নেতা সহ টাকা আদায়কারীদের ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়।

গত দেড় বছর থেকে শিক্ষা অফিসে হিসাব সহকারী মেহেদী হাসান কর্মরত থাকলেও তাকে দিয়ে অফিসের কোন কাজই করানো হয় না। বর্তমান কর্মস্থলটি নাজিম উদ্দিনের নিজ স্থায়ী ঠিকানায় হওয়ায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সাথে যোগাযোগ রক্ষাসহ স্থানীয় প্রভাব খাটিয়ে সব দখল করে টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষককে দিয়ে হিসাব সহকারীর কাজগুলোও এ উচ্চমান সহকারী একাই সম্পাদন করে থাকেন।

আফাজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো: বাবর উদ্দিন জানান, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং অফিসের উচ্চমান সহকারী কাম হিসাব রক্ষক নাজিম উদ্দিনের নির্দেশে সহকারী শিক্ষক এনায়েতে রাব্বী আমার থেকে ২০ হাজার চেয়েছে কিন্তু আমি অনুরোধ করে কিছু টাকা কম দিয়েছি।

মাইজচরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাখাওয়াত হোসেন জানান, নিম্নধাপ থেকে উচ্চধাপে বেতন নির্ধারণ সহ বকেয়া বিলের জন্য সহকারী শিক্ষক এনায়েতে রাব্বী আমার থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। তিনি আরো জানান, আমার প্রতিষ্ঠানের আরেক সহকারী শিক্ষক মুজাহিদুল ইসলাম সহ চানন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরুন নাহার পান্না, জোড়খালী হাবিব উল্লাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রোকছানা সহ আমাদের গ্রুপের ১০জন থেকেও ২০ হাজার টাকা করে নেন।
শিক্ষকরা আরো অভিযোগ করেন যে, বেতন বিবরণী অনুযায়ী শিক্ষকদের বেতন প্রদান করার কথা থাকলেও হাতিয়া প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে তা মানা হচ্ছেনা। আবার ঘুষের টাকা আদায়কারী এনায়েতে রাব্বি সহ কিছু বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রতি মাসের মাস বিবরণীতে মূল বেতনের ঘর সম্পূর্ণ ভাবে খালি রেখে মনগড়াভাবে বেতন ভোগ করে আসছে দীর্ঘদিন থেকে।

এদিকে, হাতিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের নানাবিধ অনিয়মের বিরুদ্ধে নিঝুম দ্বীপের বাতায়ন কিল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবু বকর ছিদ্দিক ৯ জুলাই ২০২৪ এ নোয়াখালী জেলা প্রথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর একটি অভিযোগ প্রেরণ করেন। যেখানে বলা হয়, ২২ জানুয়ারি ২০২৩ এর অফিস আদেশ নং-উশিঅ/হাতিয়া/নোয়া/২০২৩/৬৫ মোতাবেক তাকে নিজ এলাকায় আব্দুল মতিন পন্ডিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিস্থাপন সাপেক্ষে বদলির আদেশ দেয়। এ বিষয়ে অফিসে যোগাযোগ করতে গেলে অফিস তার থেকে ২৫ হাজার টাকা উৎকোচ দাবি করলে উক্ত শিক্ষক তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে শিক্ষা কর্মকর্তা ও হিসাব রক্ষক তার উপর ক্ষিপ্ত হন এবং ধমক দেন বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করেন।

অভিযোগের বিষয়ে দক্ষিণ চরঈশ্বর রায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এনায়েতে রাব্বী বলেন, আমি শিক্ষক আমার কাজ দান পাঠদান করা, আমি এসব বিষয়ে কিছু জানিনা।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো: আ. জব্বার জানান, এনায়েতে রাব্বীকে শিক্ষকদের থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমরা কিছু বলিনি এবং প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষক কর্তৃক জেলা শিক্ষা অফিসে অভিযোগের বিষয়ে আমার জানা নেই।

নাম প্রকাশে কয়েকজন থেকে জানা যায়, প্রতিনিয়ত হাতিয়া প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়, এখান থেকে ৫০% ভাগ পেতেন সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী। আলী সাহেবের কথা বলেও আমাদের থেকে টাকা নিচ্ছে ছোট বড় সব কাজে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাগরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন জানান, বিভিন্ন কাজের জন্য এবং যে কোন কাজের জন্য ঘুষ ছাড়া ওরা কাজ করে না, তাও আবার হাজার হাজার টাকা দিতে হয়, আমি জিজ্ঞেস করলে বলে এতো সব টাকা আমরা একা খাইনা, সাথে এমপি সাব ও আছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, উত্তর সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা বলেন, সব জায়গায় জায়গায় দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি ও ঘুষ বানিজ্য চলেছে এই এমপির আমলে, অফিসে গেলেই কোন কাজ নিয়ে ৪ অঙ্কের টাকা ছাড়া কাজ করবে না। তাই আমরাও বাদ্যগত দিতে হয়। কাজটা করার জন্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আফাজিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, অফিসে গেলে কোন কাজ নিয়ে, এই জব্বার বলে এনায়েত রাব্বির সাথে কথা বলতাম, তো এনায়েত রাব্বি বলে ওই কাজ করতে হবে এই কাজ করতে হলে এতো টাকা এতো টাকা দিতে হবে। তাহলে এতো টাকা যায় কোথায়, ভাগে যোগে সবাই খেয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, খাসের হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, আমরা কি এই ঘুষ খোরদের থেকে মুক্তি পাবো? আমরা এদের থেকে মুক্তি চাই, আমি নিজেও টাকা নিয়ে অনেক কাজ করাতে হয়েছে, তবে আবার এটাও বলেন যে আমি শুনেছি এমপি সাহেব ও এখান থেকে ৫০% করে খেতো।

এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনছুর আলী চৌধুরীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের জন্য বারবার চেষ্টা করেও তা সম্বব হয়নি।

  • শিক্ষা
  • হাতিয়া