ঈমান আনার পর বান্দার যেসব মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় বন্ধন তৈরি হয়, তার মধ্যে নামাজ অন্যতম। নামাজ যত সুন্দর হবে, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক তত মজবুত হবে। এ কারণে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। নামাজের খুঁটিনাটি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এতে বান্দা তার প্রভুর সঙ্গে নিবিড় সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে। আল্লাহ তাআলা চান বান্দা তার রবের সঙ্গে এই নামাজের মাধ্যমে সম্পর্ককে দৃঢ় করুক। নামাজের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই আল্লাহ। আমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। সুতরাং আমার ইবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে নামাজ কায়েম করো।’ (সুরা : তহা, আয়াত : ১৪)
নামাজের জন্য অপেক্ষা একটি ইবাদত:
বান্দা নামাজের মাধ্যমে তার প্রভুকে স্মরণ করে। দুজন নিরালায় কথা বলে।
নামাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রবের স্মরণেই কাটে। আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে নামাজ শেষে বান্দা আনন্দ ও মুগ্ধতায় ভরে ওঠে। নামাজের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে রবের দরবারে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে। এ কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের জন্য অপেক্ষা করাও একটি ইবাদত।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘…আমার রব আমাকে বললেন, ঊর্ধ্বলোকের অধিবাসীদের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? আমি বললাম, উচ্চ মর্যাদা লাভ ও গুনাহের কাফফারাসমূহের বিষয়ে।
আর জামাতের দিকে হেঁটে যাওয়া, কষ্টের সময়েও পরিপূর্ণভাবে অজু করা, এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। যে ব্যক্তি এগুলোর হেফাজত করবে এবং এতে অবিচল থাকবে, তার জীবন হবে কল্যাণময় এবং মৃত্যুও হবে কল্যাণময়। মাতৃ উদর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো গুনাহ থেকে সে পবিত্র হয়ে যাবে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩২৩৪)
নামাজের জন্য অপেক্ষাকারী রাত জেগে ইবাদতকারীর মতো:
এক নামাজের পর অন্য নামাজের জন্য অপেক্ষা করা এবং নামাজের ওয়াক্ত হলে তা আদায়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়া সাধারণ মানুষের অভ্যাস নয়। বরং, যাদের কাছে নামাজের গুরুত্ব রয়েছে, তারাই এই প্রতীক্ষায় থাকে। হাদিসে বলা হয়েছে, যারা নামাজের জন্য অপেক্ষা করে, তারা রাত জেগে ইবাদতকারীর মতো।
উকবা ইবনে আমির (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসুল (সা.) থেকে বলেন যে, যখন কোনো ব্যক্তি পবিত্র হয়ে মসজিদে আসেন এবং নামাজের জন্য অপেক্ষা করেন, তখন তাঁর উভয় লেখক (ফেরেশতা) প্রতি কদমের জন্য ১০টি করে পুণ্য লেখেন। আর যে ব্যক্তি বসে অপেক্ষা করে, সে যেন নামাজ আদায়রত ব্যক্তির মতো। বাড়ি থেকে বের হয়ে আবার ফিরে না আসা পর্যন্ত ওই ব্যক্তি নামাজে রত বলে গণ্য হন (এবং পুরো সময় তিনি নামাজ পড়ার সওয়াব পান)। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭৪৪০)
আমাদের অনেকের অভ্যাস হলো জামাতের অল্প কিছু মিনিট আগে মসজিদে যাওয়া। যদি একটু বেশি আগে মসজিদে চলে যাই, তখন কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ি। মনে হয়, সময় নষ্ট করছি, কিংবা কিছুই হচ্ছে না, অকারণে সময় কাটাচ্ছি। অথচ হাদিসে বলা হয়েছে, নামাজের জন্য অপেক্ষা করা নামাজে থাকার মতোই।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তির নামাজ তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখে, সে নামাজে রত হিসেবে গণ্য হবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫৯).
এ কারণে বিধান হচ্ছে, নামাজের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় কেউ যেন মসজিদে বসে দুই হাত মিলিয়ে না রাখে, অর্থাৎ এক আঙুলকে অন্য আঙুলের ভেতর ঢুকিয়ে না রাখে। কেননা সে তো এক ধরনের নামাজের ভেতরেই আছে। কাব ইবনে উজরা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন উত্তমরূপে অজু করে মসজিদের উদ্দেশে বের হয়ে যায়, তখন যেন সে তার হাতের আঙুল একটির ফাঁকে আরেকটি প্রবেশ না করায়। কারণ সে তো নামাজেই আছে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৩৮৬).
ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকেন:
নামাজের জন্য অপেক্ষা করা ব্যক্তির জন্য ফেরেশতারা নামাজ আদায় না হওয়া পর্যন্ত মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকেন। তাই আমাদের উচিত আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে প্রত্যেক নামাজের জন্য জামাতের কিছুক্ষণ আগে অপেক্ষা করার জন্য সময় বরাদ্দ থাকে। অনেকেই মসজিদে গিয়ে বসে থাকেন, তাই ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বের হন। কিন্তু একটু খেয়াল করলে যদি দু-এক মিনিট আগে বের হই, তাহলে কত বড় ফজিলত লাভ করতে পারি। আমাদের মা-বোনেরা সুন্নত পড়ে ফরজ আদায়ের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারেন। আসলে নামাজের জন্য অপেক্ষা করা জামাতের জন্য অপেক্ষা করার মাধ্যমে হৃদয় আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে। অন্তর নরম হয়ে যায় এবং মনের ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভূত হয়। এরপর নামাজ আদায় করলে নামাজে খুশুখুজু পূর্ণরূপে পাওয়া যায়।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তার নামাজের স্থানে থাকে এবং তার অজু ভঙ্গ না হয়, তাহলে ফেরেশতারা তার জন্য এই দোয়া করে: ইয়া আল্লাহ! আপনি তাকে মাফ করে দিন, ইয়া আল্লাহ! আপনি তার ওপর রহম করুন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৫৯).
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করেন:
বান্দার নামাজের জন্য অপেক্ষারত দৃশ্য দেখে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের কাছে এই দৃশ্যের কথা গর্ব করে বলেন। আমরা সাধারণত গর্ব করে এমন কিছু বলি যা আমাদের কাছে বিশেষভাবে প্রিয়। ঠিক তেমনই, নামাজের জন্য অপেক্ষা করা আল্লাহ তাআলার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এজন্য তিনি এই বিষয়টি নিয়ে গর্বিত হন।
আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করলাম। এরপর কিছু লোক চলে গেল এবং কিছু রয়ে গেল। এ সময় রাসুলুল্লাহ (সা.) দ্রুত এলেন, তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল। তিনি দুই হাঁটুর ওপর ভর করে বসলেন এবং বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমাদের রব আসমানের একটি দরজা খুলে দিয়েছেন এবং তিনি ফেরেশতাদের কাছে তোমাদের বিষয়ে গর্ব করে বলছেন, তোমরা আমার এসব বান্দার দিকে তাকাও, তারা এক ফরজ আদায় করার পর অন্য ফরজের জন্য অপেক্ষা করছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৮০১)
গুনাহ মাফ হয়:
নামাজের জন্য অপেক্ষা করা ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের সেই বিষয়টি বলব না, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা (বান্দার) গুনাহ মুছে দেন এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? (এটি হলো) কষ্টের সময় পূর্ণরূপে অজু করা, মসজিদের দিকে নামাজের উদ্দেশ্যে যাওয়া এবং এক নামাজের পর আরেক নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। আর এটিই (হলো) রিবাত, এটিই রিবাত, এটিই রিবাত (সীমান্ত প্রহরায় সর্বদা সজাগ ও প্রস্তুত থাকা)। (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ৩৭৩)