ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে মহানবী (সা.)-এর কর্মসূচি সমূহ

📄🖋: রুবিনা আক্তার
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে
ছবি: সংগ্রহীত

মহানবী (সা.) কেবল একজন নবী বা ধর্মপুরুষ ছিলেন না, বরং তিনি একজন মহান নেতা ও সফল রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তিনি একটি বৈরী পরিবেশকে পরাভূত করে একটি আদর্শ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। নবুওয়াত লাভের পর থেকেই তিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু করেন। মক্কার সংকটময় দিনগুলোতেও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল।

মক্কায় তিনটি কর্মসূচি

আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে মক্কায় মহানবী (সা.) তিনটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তা হলো—

১. মানসিক গঠন : ইসলাম আগমনের পর নবীজি (সা.) মুসলমানদের মানসিক গঠনে মনোযোগ দেন। তিনি ঈমানের দৃঢ়তা, ইবাদত তথা আল্লাহর আনুগত্য এবং রুহানিয়্যাত তথা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যমে এই কাজটি সম্পন্ন করেন। তিনি শিরকের বিপরীতে তাওহিদ, প্রবৃত্তির অনুসরণের বিপরীতে আল্লাহর আনুগত্য এবং পার্থিব মোহের বিপরীতে আল্লাহর নৈকট্যের শিক্ষা দেন। তাফসিরবিদরা বলেন, মক্কায় অবতীর্ণ সুরাগুলোতে পূর্ববর্তী জাতি-গোষ্ঠির বর্ণনা তুলনামূলকভাবে বেশি এসেছে। এসব বর্ণনা মক্কায় চলমান অত্যাচার ও নিপীড়নের মুখে মুসলমানদের মনোবল অটুট রাখতে সাহায্য করেছে এবং তাদেরকে সুন্দর ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী করেছে। কেননা এসব ঘটনায় জালিমদের পতন, মুমিনের বিজয় এবং মুমিনদের প্রতি অত্যাচারের নানা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

২. সামাজিক গঠন: মহানবী (সা.) মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমানদের নিয়ে একটি সমাজ (কমিউনিটি অর্থে) গঠন করেন। তিনি মক্কার মুসলিমদের মধ্যে এই বিশ্বাস স্থাপন করেন যে, একই সমাজে বসবাস করলেও মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায়। তাঁরা ঈমান ও ইসলামের সুতোয় বাঁধা। বিপরীতে, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না, তাদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক নেই। মুসলমানরা পরস্পরের সহযোগী এবং আশ্রয়দাতা। তারা যতটা সম্ভব সংগঠিত থাকবে, পরস্পরকে দ্বিন পালনে সাহায্য করবে এবং মুশরিকদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করবে। গোপন অথচ পৃথক ও স্বতন্ত্র এই সামাজিক মূল্যবোধ জাতি হিসেবে মুসলমানদের আত্মপ্রকাশকে সহজতর করেছিল।

৩. অস্তিত্বের জানান দেওয়া : মহানবী (সা.) নবুওয়াতের তিন বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন। তিনি প্রথমে মক্কার ভেতরে দাওয়াত দিলেও ধীরে ধীরে দাওয়াতের পরিধি মক্কার বাইরেও বিস্তৃত হতে থাকে। এই সময় তিনি হজ মৌসুমে মক্কায় আগমনকারী হাজিদের মাঝে, আরবের বিখ্যাত মেলাগুলোতে এবং তায়েফসহ মক্কার নিকটবর্তী গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে হাজির হন। এর ফলে মক্কার বাইরেও ইসলামের আহ্বান পৌঁছে যায় এবং স্থানীয় নেতৃত্ব ও শক্তিগুলো ইসলাম ও মুসলমানের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হয়। যা পরবর্তীতে মদিনা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বীকৃতি লাভে সহায়ক হয়েছিল।

মদিনায় ছয়টি কর্মসূচি

ইসলামী রাষ্ট্র গঠন ও তার বিকাশে মহানবী (সা.) মদিনায় একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে মৌলিক ছয়টি কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য।

১. মসজিদভিত্তিক সমাজ গঠন : রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করার পর প্রথমে মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদ ছিল মুসলমানদের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে ইবাদত-বন্দেগি, দ্বিনি শিক্ষা, সামাজিক কল্যাণ, সালিশ-বিচারসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হতো। মসজিদ মূলত মুসলিম সমাজকে একত্রিত করেছিল, তাদেরকে একক নেতৃত্বের অধীনে সংগঠিত করেছিল এবং তাদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলেছিল।

২. ভ্রাতৃত্ব বন্ধন : হিজরতের পর মহানবী (সা.) মুহাজির ও আনসার সাহাবিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের একটি দৃঢ় বন্ধন গড়ে তোলেন। এই বন্ধন নতুন আগত মুহাজির সাহাবিদের মদিনায় পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে একটি মানসিক সংযোগ তৈরি করে। এর ফলে তারা পরস্পরের ভাইয়ের মতো হয়ে দ্বিনি কাজে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

৩. বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি : মদিনায় হিজরতের পর মহানবী (সা.) স্থানীয় ইহুদি সম্প্রদায়সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি করেন। এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে মদিনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে মুসলিমরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

৪. মদিনা সনদ : মদিনা সনদ মূলত বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সম্পাদিত চুক্তিগুলোর একটি সম্মিলিত রূপ। এসব লিখিত চুক্তি মদিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করায় তাকে মদিনা সনদ বলা হয়। মদিনা সনদ একই মদিনা রাষ্ট্রের মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছিল।

মদিনা সনদের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ধারা হলো—

ক. বনু আওফের ইহুদিরা মুসলিমদের সঙ্গে মিলেমিশে এক উম্মতের মতো বসবাস করবে, তবে উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারবে।

খ. মুসলিম ও ইহুদি উভয় সম্প্রদায়ের লোক নিজেদের আয় উপার্জনের দায়িত্বে থাকবে।

গ. এ চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের সদস্যরা একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সদিচ্ছা ও পারস্পরিক উপকারের ভিত্তিতে কাজ করবে, কোনো অন্যায় বা পাপাচারের ভিত্তিতে নয়।

ঘ. যদি কেউ অন্যের ওপর জুলুম করে, তবে মজলুমকে সাহায্য করা হবে।

ঙ. চুক্তিভুক্ত সকলের জন্য মদিনায় কোনো ধরনের হাঙ্গামা সৃষ্টি করা বা রক্তপাত ঘটানো যাবে না।

চ. চুক্তিভুক্ত পক্ষগুলো যদি কোনো নতুন সমস্যা বা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে মীমাংসা করা হবে।

৫. বহির্বিশ্বে চিঠি পাঠানো : হুদাইবিয়ার চুক্তির পর মহানবী (সা.) প্রায় ১০ জন রাজা, বাদশাহ ও শাসকের কাছে ইসলামের আহ্বান জানিয়ে চিঠি লেখেন। তাদের মধ্যে ছিলেন, রোম সম্রাট কায়সার, পারস্য সম্রাট কিসরা, হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসি, ইস্কান্দারিয়ার (মিসর) শাসক মুকাওকিস, ইয়ামামার শাসক সুমামা বিন উসাল, শামের শাসক হারিস বিন আবি শামার গাসসানি প্রমুখ। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বেশির ভাগ অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে যায়। এর ফলে সভ্য পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও ইসলামের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে এবং বিশ্বময় ইসলামের আলোচনা শুরু হয়।

৬. সেনাবাহিনী গঠন : মহানবী (সা.) মদিনায় আগমনের পর তিনি একটি নিয়মিত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করেন। যদিও তাঁর বাহিনী প্রচলিত বেতনভুক্ত বাহিনীর মতো ছিল না, তবুও তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের অভাব ছিল না। নবীজি (সা.) তাদেরকে নিয়মিত অনুশীলন ও অভিযানের মাধ্যমে দক্ষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। মক্কা বিজয়ের সময় নবীজি (সা.)-এর বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। মক্কা বিজয়ের পর এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়।

  • ইসলামী জীবন
  • ইসলামের আলো