নিঝুম দ্বীপে পরম মমতায় যে মুগ্ধতার আয়োজন বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি- তা দেখে আর চোখ ফেরানোর কী উপায়! প্রতিটি মানুষ বিমোহিত হয়েছেন আশ্চর্য এই লীলাভূমির সৌন্দর্যে। ১৯৯৬ সালে নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। তারপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর কিন্তু এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামো বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখানে। অপার সম্ভাবনাময় নিঝুম দ্বীপ তাই এখনও নিজস্ব জীববৈচিত্র্য বা পর্যটকদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠতে পারেনি। যথাযথ পরিকল্পনা, জনবল এবং তদারকির অভাবে ধ্বংস হচ্ছে বাংলাদেশে হরিণের সবচেয়ে বড় বিচরণস্থল হিসেবে পরিচিত নিঝুম দ্বীপ। এরই মধ্যে দ্বীপে এই বর্তমান সময়ে ক্যালকুলেশন করলে ৯০ হাজারের অধিক হরিণ থাকার কথা থাকলেও এখন হরিণের সংখ্যা দাড়িয়েছে ৩ থেকে ৪ হাজারে জানিয়েছে স্থানীয়রা।
নিঝুম দ্বীপে চলাচলের জন্য পাকা সড়ক রয়েছে মাত্র একটি। তারও অবস্থা সঙ্গিন। নিঝুম দ্বীপে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি বললেও ভুল হবে না। রাক্ষসের দল শুধু খেয়েছে দেয়নি ছিটেফোঁটাও, সুপেয় পানির জন্য এই দ্বীপে নেই পর্যাপ্ত নলকূপ। বন পাহারা দেওয়ার জন্য নেই পর্যাপ্ত প্রহরী। যারা আছেন, তারা বনদস্যুদের সাথে তাল মিলিয়ে চলেন।
নিঝুম দ্বীপের চারপাশ ঘেরা ঘন সবুজ বন। বনের ভেতর সবুজ সমতল। সেই সমতলে তাঁবুর মতো সারি সারি ঘরবাড়ি দ্বীপটিকে দিয়েছে ছবির মতো সৌন্দর্য। দ্বীপের দক্ষিণে বৃত্তাকারে প্রায় ১২ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে বিশাল সি বিচ। চিকচিকে মোটা বালুকায় সৈকত ঢালু হয়ে চলে গেছে সমুদ্রের গভীরে। ভাটার সময় জেগে ওঠে দীর্ঘ বেলাভূমি।
প্রায় ৯২ বর্গমাইল আয়তনের নিঝুম দ্বীপ হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। দ্বীপের তিনদিকে আরও নতুন চর জেগে উঠছে। ১১টি চরের ৪০ হাজার ৩৯০ একর ভূমি নিয়ে নিঝুম দ্বীপ। প্রতিনিয়ত এখানে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল।
বনদস্যুরা আবাসস্থল নষ্ট করায় বনের হরিণ ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা। হরিণের বংশ বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ও পাচারকারীরা। উঁচু কোনো স্থান না থাকায় বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে বিপন্ন হচ্ছে হরিণ। হরিণের জন্য দ্বীপে নেই মিঠা পানির ব্যবস্থাও। অসুস্থ হরিণের চিকিৎসার জন্য নেই পশু হাসপাতাল। নিঝুম দ্বীপের গহিন অরণ্যে রয়েছে প্রায় সাত প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির পাখি ও ১৬ প্রজাতির সাপ। ২১ প্রজাতির বনজ সম্পদ ও ৮৩ প্রজাতির গুল্ম নিঝুম দ্বীপের সবুজ আচ্ছাদনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
বনায়নের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কোন করাত কল স্থাপনের নিয়ম না থাকলেও দেখা যায় নিঝুম দ্বীপের এই ম্যানগ্রোভ বন বিস্তৃত নিঝুম দ্বীপকে ধ্বংস করার জন্য করাত কল স্থাপন করা হয়েছে। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে ২০১৬ সালে রেঞ্জ কর্মকর্তা জাবের মিয়া থাকাকালীন সময়ে নোয়াখালী (৬) হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর অনুসারী বনদস্যু ও জলদস্যু নিঝুম দ্বীপ খবীর সর্দারের ছেলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সারোয়ার পার্টি ২ টি করাতকল স্থাপন করে, বর্তমানে সারোয়ার পার্টি, তার ভাই জামাল এবং খবির মেম্বার করাত-কল গুলো পরিচালনা করছে। যার অবস্থান নিঝুম দ্বীপ নামার বাজার বন বিভাগের বিট অফিস থেকে ৫০০ ফুট
দক্ষিনে অন্যটি সিডিএসপি বাজারের খালের পাশে সাম্প্রতি নতুন করে আরো একটি করাত-কল স্থাপন হয় বন্দরটিলা বাজারের পূর্বে স্থানীয় বিএনপি নেতা আলতাফ মেম্বারের। জানা যায় বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা ও রেঞ্জ কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব করাত কল স্থাপন করেছেন। যার কোনটির লাইসেন্স বা অনুমোদন নেই। তখনকার সময়ের রেঞ্জ কর্মকর্তা জাবের মিয়া বাঁধা দিলেও কোন সুফল পাননি। আর এখন তো কেউই বাঁধা দিচ্ছে না। নিঝুম দ্বীপের সকল গাছপালা কেটে তার করাত মিলে নিয়ে সাবাড় করে বন উজাড় করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করছে স্থানীয়রা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন ইউপি সদস্য জানান বন কর্মকর্তারা করাত-কল মালিকদের সঙ্গে আঁতাতে রয়েছেন। তাদের যোগশাজশেই এসব কল স্থাপন করা হয়েছে। তাই তারা এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন না। করাত কল মালিকরা বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের কর্মকাণ্ড।
স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা বলেন, ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে বন উজাড় করায় দ্বীপের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। আর এগুলোর পিছনে বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তার ও হাত রয়েছে। না হয় ওরা কীভাবে করাত-কল স্থাপন করে। আর এখনো নিঝুম দ্বীপে হরিণ পাচার হচ্ছে যার কারণে দিন দিন কমেছে হরিণের সংখ্যা। এখন নিঝুম দ্বীপে হরিণ নেই বললেও চলে এবং পর্যটকের আগমনও তেমন নেই।
এই বিষয়ে করাত-কলের মালিক সারোয়ার পার্টি অস্বীকার করে বলেন আমার কোন করাত-কল মিল নেই, সবাই আমার নামে মিথ্যা অপপ্রচার করতেছে, এগুলোর মালিক অন্যরা।
এই বিষয়ে বন বিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জের কর্মকর্তা সাইফুর রহমান জানান, এই বিষয়ে ঊর্ধতন কর্মকর্তাদেরকে জানিয়েছি। খুব দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে। করাত কল মালিকদের সঙ্গে আঁতাতের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি অস্বীকার করেন।
এই বিষয়ে এই বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মিল্টন চাকমা বলেন, আমি নিজে থেকেই জাহাজমারা রেঞ্জের কর্মকর্তা সাইফুর রহমানকে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জানিয়েছি। আমরা খুবই তাড়াতাড়ি এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতেছি।