হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাঁদাবাজি দুর্নীতি অনিয়মের শেষ কোথায়

📄🖋: মামুন রাফী, স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ মাস আগে
হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাঁদাবাজি দুর্নীতি অনিয়মের শেষ কোথায়

একটি রাষ্ট্রের কাছে ওই রাষ্ট্রের জনগণের যত চাহিদা থাকে, স্বাস্থ্যসেবা হচ্ছে তার অন্যতম। স্বাস্থ্য মানবসম্পদ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) ও ১৮(১)-এ চিকিৎসা সেবা ও জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা নামক এই মৌলিক চাহিদাটি পূরণ করতে গিয়ে দেশের জনগণকে কম হয়রানির শিকার হতে হয় না, বিশেষ করে জনগণ যদি যায় কোনো সরকারি হাসপাতালে।

এ দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে এসংক্রান্ত খবরাখবর। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক তদন্তে অনেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট একটি অসাধুচক্র যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই ওই অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এ ধরনের দুর্নীতি গুলোকে বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী ‘পুকুরচুরি’ না বলে ‘সাগরচুরি’ বলাই ভালো।

ভালোভাবে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছুসংখ্যক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে দুর্নীতির শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। ‘শক্তিশালী’ এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ‘সিন্ডিকেট’ গঠন করে স্বাস্থ্য খাতে জনসাধারণের জন্য বরাদ্দ সরকারি বাজেটের একটি বড় অংশ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে জনগণ তাদের প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা থেকে নিয়মিত বঞ্চিত হচ্ছে। গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা, চিকিৎসা সেবায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ওষুধ সরবরাহসহ ১১টি খাতে দুর্নীতি বেশি হয়।

এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশও করে ওই সংস্থা। তখন স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে সংসদেও বহু বার প্রশ্ন উঠেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি থেমে নেই। বরং তা পাগলা ঘোড়ার মতো দ্রুত বেগে চলমান। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটা, ঋণ ব্যবহারসহ যেসব বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে এবং দুর্নীতি হচ্ছে, তা দ্রুত ভালোভাবে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক।

তেমনি জনবল সংকট আর মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি নিয়ে চলছে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সেবা কার্যক্রম। প্রতিদিনই উপচে পড়া রোগীদের চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে দায়িত্বরত ডাক্তার নার্সদের। অপরদিকে সংস্কার বিহীন ও যুগ অনপোযোগী চিকিৎসা সরঞ্জামের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সেবা প্রত্যাশী রোগীদের। ফলে ব্যাহত হচ্ছে দ্বীপবাসীর চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বর্তমানে ১ জন শিশু বিশেষজ্ঞ ছাড়া কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। বিধি মোতাবেক ২১ জন এমবিবিএস ডাক্তারের স্থলে টিএইচও সহ মাত্র ১১ জন থাকলেও ৩ জনই ট্রেনিং ও ছুটি জনিত কারণে হাতিয়ার বাইরে থাকায় বর্তমানে উপস্থিত মাত্র ৮ জন ডাক্তার। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সরাসরি স্যাকমো নিয়োগ প্রাপ্ত দুজন হলেও ডিউটি করছেন ৮ জন। বাকি ৬ জনের সাব সেন্টারে ডিউটি করার কথা থাকলেও তার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিতে ডিউটি করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।


অন্যদিকে ৪১ জন নার্সের স্থলে ২৮ জনের পদই শূন্য রয়েছে। কাগজে কলমে ১৩ জন দেখালেও উপস্থিত রয়েছেন নার্স ইনচার্জ সহ মাত্র ৭জন। হাতিয়া ৫০ শয্যা হাসপাতালে প্রতিদিনই প্রায় শতাধিক রোগীর সেবা প্রদানে মাত্র ৬ জন নার্সকে ২৪ ঘণ্টা রোটেশনে সেবা দিতে গিয়ে তারা হাঁপিয়ে উঠছেন। ফলে সেবা প্রার্থী মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।একইভাবে ওয়ার্ড বয়, আয়া ও সুইপারের পদ খালি না থাকলেও কর্মস্থলে তাদের কেউ হাজির থাকেন না বলে জানা যায়। তাদের কেউ ডিপুটেশনে হাতিয়ার বাইরে কাজ করছেন। কিন্তু মাসিক বেতন ভাতা উত্তোলন করেন হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। ফলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আগত সেবা প্রার্থীদের অনেক অভিযোগ রয়েছে। সাড়ে ৭ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দ্বীপ উপজেলার একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র এ হাসপাতাল।

১৯৯৮ সাল থেকে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও বিগত বছর ধরে কোন ভবন না থাকায় বেড সংখ্যা একই রয়েছে। কেবল মাত্র ৫০ জন রোগীর জন্য খাবার ও ঔষধ পত্রের সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ এ হাসপাতালে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে প্রায় শতাধিক। অনেক সময় রোগীদেরকে করিডোরে, চলাচলের পথে, ডাস্টবিন সংলগ্ন খোলা জায়গায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। দুর-দূরান্তের সেবা প্রত্যাশীরা যানবাহন ভাড়া দিয়ে কষ্ট করে এসেও কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

হাসপাতালটিতে রোগ নির্ণয়ে ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কাজে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তার মধ্যে দু’একটি ছাড়া সবগুলোই মান্ধাতার আমলের এনালগ সিস্টেমের বলে জানা যায়। ডিজিটাল যুগে এসব যন্ত্রপাতি দিয়েই কোনো রকমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কার্যক্রম চালাতে হয়। এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এখন অনেক পরীক্ষারই রিপোর্ট ঠিকমতো দেয়া সম্ভব হয় না। দীর্ঘ ২০ বছর ধরেই বিকল অবস্থায় পড়ে আছে এক্সরে মেশিন। কাজ করছে না আলট্রাসনোগ্রাাম মেশিনটিও। মেশিনগুলো বিকল থাকার কারণে রোগীরা হাসপাতাল থেকে ভালো মানের চিকিৎসা নিতে পারছেন না। ফলে দিন দিন বাড়ছে রোগীদের ভোগান্তি।

শুধু তাই নয়, দায়িত্বরত কয়েকজন সাব-এসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের রয়েছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবের ব্যবসা। তারা বেশীর ভাগ রোগীকে দায়িত্বরত অবস্থায় তাদের সেই সকল প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ল্যাবে যেতে উৎসাহিত করে। তার উপর রয়েছে দালালদেরও উপদ্রব। তারা অপকৌশলে রোগীদের প্রাইভেট মেডিকেল এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাবে নিতে বাধ্য করে। এমনকি রোগীদের হাসপাতালে ভর্তিসহ চিকিৎসায়ও নানা প্রতারণার আশ্রয় নেয়। অতিরিক্ত ফ্রি দেওয়ার পাশাপাশি গ্রাম গঞ্জ থেকে আসা অনেকে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়। এতে প্রতিনিয়তই অসংখ্য মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

এদিকে গত ৫ সেপ্টেম্বর সিভিল সার্জন ডাঃ মাসুম ইফতেখারস্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানা যায় উপ- সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার জনাব ওমর ফারুক রিয়াজ কে হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সোনাইমুড়ী, সোয়াখালীতে বদলি। এবং জনাবা শারমিন আক্তার উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার কাশিপুর উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সোনাইমুড়ী, নোয়াখালী। থেকে বদলি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, হাতিয়া নোয়াখালীতে। এবং এটাও বলা হলো তাদেরকে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর থেকে আদেশকৃত কর্মস্থলে যোগদান করতে হবে নতুবা পরের দিন হতে সরাসরি ছাড়পত্র প্রাপ্ত বলে গন্য হবে।

ওমর ফারুক রিয়াজের বদলির নোটিশ

গোপন সুত্রে জানা যায় ওমর ফারুক রিয়াজ প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে হাত করে ১৫ লক্ষ টাকা লেনদেন করে বদলি না হয়ে আগের জায়গায় বহাল রয়েছেন, যেখানে সোনার খনি রয়েছে সেখান থেকে ওনি কেন বদলি হবেন, ১৫ লক্ষ টাকা দিলে হলেও তাকে এখানে থাকতে হবে।

সোমবার ২৪ সেপ্টেম্বর সকালে উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নারী, শিশু, বয়স্ক প্রচুর রোগীর চাপ। কয়েকটি বেডে দুজন রোগী এক সাথে বসে আছে। অনেকে আবার নিঝুম দ্বীপসহ প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এসে বেড না পেয়ে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। এক মা তার এক দেড় বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ফ্লোরে সেবা নিতে ও দেখা যায়।

এক রোগীর বাবা বলেন, ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে আসছি ছিট খালি নাই। বিকল্প একটা সিটে রোগীকে নিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক বসে থাকার পরেও কোন নার্স আসেনি। পরে আমি উত্তেজিত হয়ে গেলে নার্স এসে ক্যানোলা করে ইনজেকশন পুশ করে। কিন্তু বাথরুমের নোংরা পরিবেশ, টয়লেটের দুর্গন্ধ সহ্য করে আজ ২ দিন সেবা নিতে গিয়ে আমার স্ত্রী নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

দায়িত্বরত নার্স ইনচার্জ মোহছেনা আক্তার তামান্না বলেন, দু’একদিন পরপরই রোগীর চাপ অনেক বেশি থাকে। অনেক দিন থেকে আমাদেরকে বেড সংখ্যার তিনগুণ রোগী ভর্তি করাতে হচ্ছে। অন্যদিকে রোটেশান মাফিক স্টাফ নার্স সংখ্যা ৩ জন। অধিক সংখ্যক রোগীদের একত্রে সমানভাবে সেবা দিতে পারা যায় না। সেবা দিতে বিলম্ব হলে রোগীদের দুর্ব্যবহারও শুনতে হয়। আমাদের কিছুই করার থাকেনা।

এ বিষয় নিয়ে ওমর ফারুক রিয়াজ জানান, আমি অসুস্থ এই সব বিষয়ে কথা বলতে চাই না। তিনি ঢাকা নিউজ প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে নারাজ। এই বলে তিনি কল কেটে দেন।

হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মানষী রানী সরকার কে বার বার কল করেও কোন রেসপন্স পাওয়া যায়নি।

জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মাসুম ইফতেখার মুঠোফোনে হাসপাতালের সার্বিক বিষয়ে জানান, ওমর ফারুক রিয়াজ কে বদলির নোটিশ দিলো সেটা পরিবর্তন করে আমরা তাকে সাসপেন্ডে রেখেছি যদি সব অনিয়মের পরিবর্তন আসে তাহলে পুনরায় বহাল থাকবে, না হয় তাকে বদলি করে দেওয়া হবে। দালালের দৌরাত্ম্য নিয়ে অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, টিএইচওকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে।

  • দুর্নীতি ও অনিয়ম